পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় 40 মিলিয়ন মানুষ দৃষ্টিশক্তিহীন এবং প্রায় 124 মিলিয়ন মানুষ স্বল্প দৃষ্টি সম্পন্ন। যার দৃষ্টিশক্তি নেই সেই জানে এর মর্ম। এতদিন চোখ নষ্ট হয়ে গেলে, আমাদের অপেক্ষা করতে হতো কোন চক্ষু দাতার জন্য। অনেক বৃদ্ধ মানুষ বয়সজনিত কারণে এবং অনেক কম বয়সি লোকেরাও বিভিন্ন রোগ ও দুর্ঘটনার কারণে দৃষ্টি হারান। ভাগ্য ভালো থাকলে চক্ষু দাতার দান করা চোখে, তারা পুনরায় দৃষ্টি ফিরে পান। পুনরায় দেখতে পারেন রঙিন পৃথিবীর আলো। অনেকই মরণোত্তর দেহ দান করেন বা বা মরণোত্তর চক্ষু দান করেন, দৃষ্টিহীন ব্যক্তিদের চোখে আলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুবই কম। ফলে একবার দৃষ্টি হারালে সারা জীবন অন্ধকারে কাটাতে হয়েছে অনেক ব্যক্তিকে। এই সমস্যা ভাবিয়ে তুলেছিল অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষকদের। প্রায় এক দশক ধরে তারা চালাচ্ছিলেন কৃত্রিম চোখের বা ‘বায়োনিক আই’ নিয়ে গবেষণা। সেই গবেষণা আজ সফল হয়েছে। প্রস্তুত হয়ে গেছে, পৃথিবীর প্রথম “বায়োনিক আই” বা কৃত্তিম চোখ। এই কৃত্তিম চোখ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সহজেই দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা আবার দৃষ্টি ফিরে পাবেন।
Table of Contents
‘বায়োনিক আই’ কি ? (What is Bionic eye)
‘বায়োনিক আই’ বা কৃত্তিম চোখ হল বিভিন্ন যন্ত্র, সার্কিট ও ক্যামেরা নিয়ে তৈরি একটি ব্যবস্থা ,যার সাহায্যে স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন বা দৃষ্টিহীন ব্যক্তিদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। অপারেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক চোখের জায়গায় এই কৃত্তিম চোখ প্রতিস্থাপন করতে হয়। এই কৃত্তিম চোখের সামনে একটি বিশেষ লেন্সের চশমা ব্যবহার করা হয়। এই চশমার সাহায্য সামনে থাকা বস্তুর চিত্র গৃহীত হয়।
আমাদের চোখ কিভাবে কাজ করে? (Working of Eye)
বায়োনিক আই বা নকল চোখ কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে গেলে, আমাদের আগে বুঝতে হবে, আমাদের চোখ কিভাবে কাজ করে।
আমাদের চোখে আলো পড়লে, চোখের লেন্স এবং কর্নিয়া সেই আলোকে চোখের ভেতরে রেটিনার উপর ফোকাস করে। আমাদের চোখে রেটিনা নামের স্তরটি, আলোক সংবেদী কোষ দ্বারা গঠিত। এই রেটিনা বাইরের জগত থেকে প্রাপ্ত আলো এবং ছবিকে ইলেকট্রিক সিগন্যাল বা স্নায়ু স্পন্দনে (Neural Impulses) রুপান্তর করে।
এই স্নায়ু স্পন্দন, দর্শন স্নায়ু (Optic Nerve) বরাবর আমাদের মস্তিষ্কের থ্যালামাস নামের একটি জায়গায় পৌঁছায়। সেখান থেকে ওই সিগন্যাল বা স্নায়ু স্পন্দন আমাদের মস্তিষ্কের পিছনের দিকে, ভিজুয়াল কর্টেক্স নামে একটি জায়গায় পৌঁছে যায়। ভিজুয়াল কর্টেক্স এ আমাদের দেখা বস্তুর প্রতিবিম্ব গঠিত হয়। ফলে, আমরা বস্তুর রং, আকৃতি, গতিবেগ ইত্যাদি বুঝতে পারি।
বায়োনিক আই কিভাবে কাজ করে? (How Bionic Eye works)
বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই অন্ধত্বের মূল কারণ হলো, ক্ষতিগ্রস্থ লেন্স বা খারাপ হয়ে যাওয়া কর্নিয়া। কর্নিয়া অথবা লেন্স খারাপ হলে, আলোকে ঠিকমতো রেটিনার উপর ফোকাস করতে পারে না। অনেকের ক্ষেত্রে রেটিনা খারাপ হওয়ার কারণে, গৃহীত আলো বা ছবিকে স্নায়ু স্পন্দনে রূপান্তর করতে পারেনা। এই সমস্যা দূরীকরণের জন্য, তৈরি করা হয়েছে ‘বায়োনিক আই’।
এই ‘বায়োনিক আই’ সিস্টেমটি দুটি অংশ নিয়ে গঠিত।
1) চশমা সহ একটি হেড গিয়ার: এর প্রধান অংশ গুলি হল– একটি ভিডিও ক্যামেরা, একটি ভিজুয়াল প্রসেসর, সফটওয়্যার এবং একটি ওয়ারলেস ট্রান্সমিটার। এটি দেখতে অনেকটা চশমার মতো। এই যন্ত্রটি সাধারণ চশমার মতোই পরতে হয়।
2) ‘বায়োনিক আই’ বা নকল চোখ: এর প্রধান অংশ গুলি হল– ওয়ারলেস সিগন্যাল রিসিভার, সার্কিট সহ কয়েক জোড়া টাইলস, চুলের মতো সরু কিছু ইলেক্ট্রোড। এই যন্ত্রটিকে দেখতে অনেকটা আমাদের চোখের মতো। অপারেশন এর মাধ্যমে আসল চোখের জায়গায় এটিকে লাগিয়ে দেওয়া হয়।
বায়োনিক আই এর কার্যপ্রণালী: (Bionic Eye Technology)
চশমার সামনে রয়েছে একটি ছোট ভিডিও ক্যামেরা। এই ক্যামেরা দিয়ে গৃহীত হবে ছবি। এরপর এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশ গুলি রেখে অতিরিক্ত অংশগুলি বাদ দিয়ে দেওয়ার জন্য (চিত্রকে কম্প্রেস করার জন্য) পাঠানো হবে, হেড গিয়ারে থাকা প্রায় স্মার্টফোন এর সমান আকারের, একটি ভিজুয়াল প্রসেসর এ।
ভিজুয়াল প্রসেসর এর কম্প্রেশ হওয়া ছবি, ওয়ারলেস ট্রান্সমিটার এর সাহায্যে পাঠিয়ে দেওয়া হবে অপারেশন করে বসানো, ‘বায়োনিক আই’ বা নকল চোখে।
এই ‘বায়োনিক আই’ এর ভেতরে থাকা, বিশেষ সার্কিট দিয়ে তৈরি টাইলস গুলো কাজ করবে রেটিনার মতই। এগুলোর কাজ আগত আলো বা চিত্রকে স্নায়ু স্পন্দনে (Neural Impulses) রূপান্তর করা। চুলের মতো সরু কিছু ইলেক্ট্রোড এই স্নায়ু স্পন্দনকেদর্শন স্নায়ু (Optic Nerve) বরাবর আমাদের মস্তিষ্কে পাঠায়। চোখের সামনে থাকা বস্তুর প্রতিবিম্ব গঠিত হয় সর্বোচ্চ 473 টি আলোক বিন্দু (phosphenes) দ্বারা। যা সামনের থাকা বস্তুকে মোটামুটি চিনতে সহায়তা করবে।
‘বায়োনিক আই’ এর ভবিষ্যৎ (Bionic Eye Future)
যদিও এখনো এই টেকনোলজি এতটা উন্নত হয়নি যে পুরোপুরি অন্ধত্বকে দূর করতে পারবে। আমাদের স্বাভাবিক ভাবে দেখতে হলে, প্রায় 10 লক্ষ আলোক বিন্দু দ্বারা উৎপন্ন চিত্র দরকার। এই ‘বায়োনিক আই’ যন্ত্র দিয়ে সর্বাধিক 473 টি আলোক বিন্দু দারা চিত্র গঠিত হয়। ইলেক্ট্রোডের সংখ্যা বৃদ্ধি করে, আলোক বিন্দু সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য গবেষণা চলছে। গবেষণা টির হিউম্যান ট্রায়াল ও সফল হয়েছে। বর্তমানে যে পর্যায়ে গবেষণাটি পৌঁছে গেছে, তাতে যে কোনো অন্ধ ব্যক্তি, সামনে থাকা বস্তু সম্পর্কে মোটামুটি একটি চিত্র দেখতে পাবে। ফলে তাদের একলা চলা ফেরা করতে কোন রকম অসুবিধা হবে না। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা সেই দিন দেখতে পাবো, যেদিন অন্ধত্ব নামের কোন সমস্যা আর পৃথিবীতে থাকবে না।
‘বায়োনিক আই’ এর আবিস্কারক (Bionic Eye Inventor)
অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটির (Monash University) কিছু গবেষক, প্রায় এক দশক ধরে গবেষণা করে বানিয়ে ফেলেছেন কৃত্তিম চোখ বা ‘বায়োনিক আই’।
(তথ্য সূত্র: মোনাস ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট)
আরো পড়ুন:
ভারতেই রয়েছে পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান জাতীয় উদ্যান
মুম্বাইতে আবিষ্কৃত হল নতুন প্রজাতির মাকড়সা
আমাদের অন্যান্য লেখা গুলো পড়তে click করুন