বহুকাল ধরে বাংলার একটি প্রচলিত প্রবাদ হলো, “রাতে মশা, দিনে মাছি; এই নিয়ে, বেঁচে আছি।”
‘মশা’ খুবই বিরক্তিকর এক প্রাণী এবং বহু রোগর বাহক। এখনো পর্যন্ত প্রায় 3600 প্রজাতির মশার হদিস পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এরমধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রজাতি গুলি হল এনোফিলিস, কিউলেক্স ও এডিস মশা। মশা- ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জাপানিজ এনকেফেলাইটিস, হলুদ জ্বর, ফাইলেরিয়া এবং আরো বহু প্রাণঘাতী রোগ ছড়ায়। যেসব প্রাণীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন রোগ ছড়ায় বা বিভিন্ন ভাবে ক্ষতি করে তাদের বলা হয় ভেক্টর। মশাও এক ধরনের ভেক্টর।
WHO এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে প্রায় 70 কোটি মানুষ আক্রান্ত হন মশা বাহিত বিভিন্ন রোগে। তার মধ্যে প্রায় 10 লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।
তাই মশা আমাদের কাছে আতঙ্কের একটা নাম। এই মশা দূর করার জন্য বাজারে বহু উপায় প্রচলিত রয়েছে। মশা মারার জন্য বিভিন্ন রকম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় যেমন ডিডিটি, ব্লিচিং পাউডার, মশা মারার কয়েল বা ধূপ, মশা মারার স্প্রে, মশা মারার ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্র, মশা মারার ক্রিম, ইত্যাদি। এগুলো পরিবেশের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি আমাদের দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তবুও একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমরা আজও ব্যবহার করে চলেছি এই সমস্ত রাসায়নিক পদার্থ। কারণ মশা তাড়ানোর আর কোন বিকল্প উপায়ও নেই।
জৈবিক পদ্ধতিতে মশা মারার জন্য বিকল্প উপায়ের সন্ধান দিচ্ছেন, রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ সেন্টেনারি কলেজের অধ্যাপক ও গবেষক ড. স্বপন ঘোষ। তিনি খুঁজে বের করেছেন মশা মারার এক অভিনব উপায়। ‘ট্রাইকোডার্মা অ্যাসপেরেলাম’ নামের একটি ছাত্রকে জমিতে ব্যবহার করা হয় জৈবিক জীবাণুনাশক হিসেবে। এই ছত্রাকের সাহায্যে মশা মারা যেতে পারে, এটিই তাঁর আবিষ্কার। এই ছত্রাক এর কাছাকাছি এলেই ধ্বংস হবে মশা। মশার লার্ভা ভর্তি নর্দমাতে কয়েক ফোঁটা ‘ট্রাইকোডার্মা অ্যাসপেরেলাম’ ফেলে দিলে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ধ্বংস হবে মশার সমস্ত লার্ভা। প্রথমে ছত্রাক দিয়ে বানিয়েছেন একটি বিশেষ পাউডার। পরীক্ষামূলক ভাবে খড়দহ পুরসভায় বিভিন্ন নিকাশি নালায় মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হয় এই পাউডার। ব্যাপক সাফল্য মেলে। সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় সাইন্টিফিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর এই আবিষ্কার।
মশার লার্ভা কিভাবে নষ্ট করবে ট্রাইকোডার্মা অ্যাসপেরেলাম ? (How to kill mosquito by Trichoderma Asperellum)
মশার লার্ভা জমা জলে ট্রাইকোডার্মা অ্যাসপেরেলামের সলিউশন ফেলে দিলেই ছত্রাকের স্পোর বা রেণু লার্ভার গায়ে আটকে যাবে। এর পরেই ছত্রাক স্বাভাবিক নিয়মে অঙ্কুরিত হতে শুরু করার সাথে সাথেই কাইটিনেজ এবং প্রোটিয়েজ নামে দুটি উৎসেচক নির্গত হতে শুরু করবে। এই উৎসেচক গুলি মশার লার্ভার কোষের, কোষ প্রাচীরকে ভেঙে দেবে। ফলে মৃত্যু ঘটবে মশার লার্ভার।
এর আগে ওই ছত্রাক দিয়েই, অ্যালোভেরা গাছের অল্টারনেরিয়া ব্রেসিকা নামের ছত্রাক ঘটিত রোগ সরিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। এবার মশা এবং মশার লার্ভা ধ্বংস করার জৈবিক পদ্ধতি আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব।
শুধু মশার লার্ভাই নয়, জীবিত পূর্ণাঙ্গ মশা মারার জন্য তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন ‘মশা খেকো কাগজ’ বা ‘মশা মারার ম্যাগনেট’ । এই ছত্রাকের দিয়ে বানানো পাউডার এবং কাগজ, এই দুটি উপাদান দিয়ে এটি বানানো হয়েছে। ছোট্ট একটি ‘মশা খেকো কাগজ’, বাড়িতে টাঙ্গিয়ে রাখলে, মশাগুলি এই কাগজের রাসায়নিক দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে, এই কাগজ এসে বসবে। তৎক্ষনাত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে এবং কিছুক্ষনের মধ্যে মারা যাবে। পালাবার কোন উপায় নেই। এই কাগজটি তিনি বানিয়েছেন ‘ট্রাইকোডার্মা অ্যাসপেরেলাম’ ছত্রাকের ‘স্পোর’ এবং ‘মেটাবলাইটস’ দিয়ে। এটিকে নাম দেওয়া হয়েছে মশা মারার ‘ডোমেস্টিক কিট’।
প্রায় চার বছর ধরে তিনি এবং তার ছাত্ররা চালাচ্ছিলেন গবেষণা। সেই গবেষণা সফল হয়েছে। আপাতত পেটেন্ট এর জন্য আবেদন করেছেন ওনারা। পেটেন্ট পেয়ে গেলেই বাণিজ্যিকভাবে তৈরি শুরু হয়ে যাবে মশা মারার ডোমেস্টিক কিট এর।
স্বপন বাবু সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, প্রতিটি মশা মারার কিটে 10 টি পেপার থাকবে। প্রতিটি পেপার তৈরি করতে খরচ পড়বে মাত্র 8 টাকা। এক একটি পেপার এর আয়ু 15 দিন। স্বপন বাবুর মতে, একটি দশ বাই বারো রুমের মধ্যে দুটো থেকে তিনটে কাগজ হলেই চলে যাবে। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই মিলবে মশা মারার ডোমেস্টিক কিট।
কিভাবে কাজ করবে এই মশা মারার ডোমেস্টিক কিট ?
ঘরের যেকোনো স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে এই কাগজগুলি কে। মশা এই কাগজের সাত ফুটের মধ্যে এলেই, কাগজের রাসায়নিক পদার্থের টানে কাগজের উপর এসে বসবে এবং তৎক্ষনাত জ্ঞান হারাবে। তারপরেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। পালাবার সুযোগই পাবে না। স্বপন বাবু দাবি সব প্রজাতির মশা মরবে এই ডোমেস্টিক কিট এর সাহায্যে। রিহার্সাল এ পাস করেছে তার এই আবিষ্কার।
এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পেটেন্ট পাওয়া। কোন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হলে সহজেই পেটেন্ট পাওয়া যায়। কিন্তু ছত্রাক তো এক ধরনের জীব। এর উপর বা এর কার্যকারিতার ওপর পেটেন্ট পাওয়া সহজ নয়। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এবং বহু মানুষের সহযোগিতায় স্বপন বাবু এই গবেষণাটি করেছেন। পেটেন্ট পাওয়ার বিষয়ে তিনি আশাবাদী।
কোটি টাকার মশা মারার রাসায়নিকের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারে এই জৈবিক মশা দমন পদ্ধতি। আমাদের দেশে বাঙালি বিজ্ঞানীর এই আবিষ্কার, স্বীকৃতি পাবে কি? জানাতে পারেন আপনার মতামত নিচের কমেন্ট বক্সে।
Hope Dr Ghose’s invention will get the ‘patent’ as it will help humanity fight against mosquitoes.